মোহাম্মদ মাসুদ
দেশে ইতিহাসে যুগান্তকারী রায়ের ধারাবাহিকতায় মেয়র হলেন ডা. সাহাদাত হোসেন। ১২ সিটির মধ্যে ৭গুনেরও বেশি ভোটে বিপক্ষের পদপ্রার্থী নৌকা প্রতীকে প্রার্থী বিএনপি’র শীষ পথিকের প্রার্থীকে পরাজিত করে। পরাজিত প্রার্থী বিজয়ী প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী সহিংসতায় ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ব্যাপক ও নিয়ম অভিযোগে মামলা করেন। নজিরবিহীন নির্বাচনে সকল কাউন্সিলরই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মী ও প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। যা নানা সমালোচনায় নেতিবাচক প্রশ্নবিদ্ধ হয় জনমনে। দেশজুড়েও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
এই প্রথম নির্বাচিত মেয়রের এক চতুর্থাংশ সময়ের কিছু সময় বেশি বাকি থাকা সত্ত্বেও নির্বাচিত মেয়র কে বাতিল ঘোষনায় মামলার বাদীর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কে মেয়র ঘোষণা করেন আদালত। মেয়র পদে বসতে পারবেন কিনা এ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা রাজনৈতিক অঙ্গনে নগরজুড়ে জনমনে ও সারা দেশজুড়ে। বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেন। চসিক মেয়র ডা.সাহাদাত হোসেন। যা শীর্ষ আলোচিত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া অনলাইন পত্রিকা ও সবার মাঝে।
শাহাদাত হোসেন কখন শপথ ও সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব নেবেন, কতদিন দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, দায়িত্ব নিতে কোনো আইনি জটিলতা আছে কিনা– এসব বিষয়েও চলছে আলোচনা। তবে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করলে মেয়রের দায়িত্ব নিতে শাহাদাতের বাধা নেই। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচিত সব মেয়রকে অপসারণ করে গত ১৯ আগস্ট সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। মূলত এ কারণে এই আলোচনার সূত্রপাত।
বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে আদালতের রায়ের সাত দিন পর প্রজ্ঞাপন সংশোধন করে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর পরও তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বসতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে নগরজুড়ে চলছে আলোচনা। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও চলছে নানা গুঞ্জন।
সাধারণত মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মেয়রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অভিনন্দন জানান। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে মেয়র হওয়া ডা. শাহাদাত হোসেনের ক্ষেত্রে সতর্ক পা ফেলছেন তারা। বিএনপিপন্থি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যোগাযোগ রক্ষা করলেও অন্যরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন। তবে এর মধ্যেই শপথ নেওয়ার প্রতীক্ষায় আছেন ডা. শাহাদাত হোসেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর নগরবাসীর দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
কতদিন হবে মেয়াদ
২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনে মেয়র পদে জয়ী নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম দায়িত্ব নিয়েছিলেন ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি। ২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নির্বাচিত পরিষদের প্রথম সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। আইন অনুযায়ী, প্রথম সভার তারিখ থেকে পাঁচ বছর নির্বাচিত পরিষদের মেয়াদ। সেই হিসাবে ২০২৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এ হিসাবে চলতি মাসে শপথ নিলে ডা. শাহাদাত সর্বোচ্চ ১৬ মাস দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। আর তিনি যদি পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তাহলে ১৩ মাস দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। কারণ আইন অনুযায়ী, নির্বাচিত পরিষদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে।
জানতে চাইলে বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত বলেন, ‘যেটুকু সময় পাব তাতে চট্টগ্রামকে ক্লিন, গ্রিন ও হেলদি সিটি গড়তে চেষ্টা করব। নগরবাসীর দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজে অগ্রাধিকার থাকবে। একটি বাসযোগ্য নগর গড়তে আমার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকবে।’
শপথ কখন
সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, নির্বাচন কমিশনের জারি করা প্রজ্ঞাপন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আসার পর আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের মতামত চাওয়া হবে। কোনো আইনি জটিলতা না থাকলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার কাছে সময় প্রার্থনা করা হবে। প্রধান উপদেষ্টার সময় অনুযায়ী শপথের জন্য ডা. শাহাদাত হোসেনকে চিঠি পাঠানো হবে। শপথের পর যে কোনো মুহূর্তে মেয়রের দায়িত্ব নিতে পারবেন তিনি। শপথের জন্য কতদিন সময় লাগবে, তা লেজিসলেটিভ বিভাগের সম্মতির ওপরও নির্ভর করছে।
তবে গতকাল বুধবার বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো চিঠি আসেনি বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘চিঠি আসুক। এর পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে তিনি (ডা. শাহাদাত হোসেন) কখন শপথ নেবেন এবং দায়িত্ব গ্রহণ করবেন, তা নির্ভর করছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ওপর। মন্ত্রণালয় থেকে যেভাবে নির্দেশনা দেবে, আমরা সেভাবে পদক্ষেপ নেব।
আইনি জটিলতা কী
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। ১৭ আগস্ট স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯ সংশোধন করে সরকার। এর পর রেজাউল করিম চৌধুরীসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করে। একই দিন সরকারি কর্মকর্তাদের সিটি করপোরেশনের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসক হিসেবে বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যেই ১ অক্টোবর ডা. শাহাদাতকে মেয়র ঘোষণা করেন নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল ও চট্টগ্রামের যুগ্ম জেলা জজ আদালত। এর আলোকে প্রজ্ঞাপন সংশোধন করে গত মঙ্গলবার রাতে বিজ্ঞপ্তি জারি করে ইসি। তাতে মেয়র হিসেবে রেজাউল করিম চৌধুরীর স্থলে শাহাদাত হোসেনকে উল্লেখ করা হয়।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত সরকার আপিল করেনি। নির্বাচন কমিশনও প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। তাই শাহাদাত হোসেনের মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। সরকার আপিল না করলে শপথের মাধ্যমে তিনি মেয়রের দায়িত্ব নিতে পারবেন।