পলাশ দেব
আকাশ থমকানো মেঘলা। গুম-ধরা আকাশের মাঝখানটা যেন সেঁকা রুটির পেটের মধ্যেকার মতো। বাতাস নেই। গাছের পাতাটিও নড়ছে না। ঝরঝর করে ঘাম দিচ্ছে শরীরটা। ঘামে ভেজা ঠান্ডা শরীরে ঢুকলেই প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হবে। দুপুরবেলার এই ভ্যাপসা গরমে বড্ড সুনসান প্রকৃতি। মানুষ তো দূরের কথা, পথেঘাটে একটি নেড়ী কুত্তাও নেই।
একখানা রিক্সা ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ করতে করতে চলেছে। আজকাল গাঁও-গ্রামে রিক্সার আদল বদলে গেছে। ব্যাটারি আর মটর লাগানো। প্যাডেল ঘোরানোর দিন এখন ইতিহাসের পাতায় উঠি উঠি করছে। নাম বদলে রিক্সা এখন হয়েছে টমটম।
টমটমটা বেশ গতিতে ঝাঁ করে চলে গেলো। হাতের ইশারা খেয়ালই করেনি টমটমওয়ালা।একটু দ্রুত পৌঁছতে হবে। টমটমটা পেলে মন্দ হতো না। যা গরম পড়ছে …
কিন্তু গরম পড়লে কি হবে! সন্ধ্যের আঁধার নামতে না নামতে মশারীর মতো চারপাশ থেকে কুয়াশার পর্দা নামে। চারদিকে জ্বর-জারী হচ্ছে খুব।অনেক দূরে রাস্তার ধারের ক্ষেতে ঠাঁঠাঁ রোদে পিঠে টোকলা বেঁধে কাজ করছে দুএক জন চাষী। বৃষ্টি আসলে বেশ উপকার হতো ফসলের।
কিন্তু ঝড় বৃষ্টির যিনি কারিগর তাঁর আজকাল নব্য পুঁজিবাদী সরকারের মতো প্রলেতারিয়েতদের বড় না-পছন্দ!
বৃষ্টি নামবে ঠিকই। ক্ষেতের কাজ শেষ হয়ে ফসল তোলার সময় হলেই শুরু হবে বৃষ্টির খেমটা নাচুনী। হড়হড়িয়ে বন্যায় ভাসবে চারদিক!
মাঠের ফসল ভাসবে মাঠে।ঝিম ধরা মুরগীর মতো হাঁটতে হাঁটতে সেইতো বটতলায়।
বটতলার ঝুপরি দোকানের বাইরে প্লাস্টিকের টেবিলের উপর জলের জগ আর গ্লাস।
গ্লাসে জল ঢেলে ঢকঢক করে গলায় ঢেলে দিলো।
জগের জল আগুনের মতো ততা! মিঠেজলের স্বাদ নেই একটুও। এতো দরকচা জলে তেষ্টা মরে না! যা গরমটা পড়েছে! জলের কি ঠাঁট থাকার জো আছে?একটু জিরিয়ে নাও; বললো ঝুপরিওয়ালা।
-হুম, বসছি, একটু চা হবে কি? আগন্তুক বললো।
এই যাচ্ছি। ঠক্ করে একটা কাপ রাখলো টেবিলের উপর ঝুপরিওয়ালা।
আজকাল জলের বড় আকাল চলেছে না রে সদা?
– হুম দাদা। ঝুপরিওয়ালা সদানন্দ একটু ঝুঁকে মাথা নাড়িয়ে আবার বলতে শুরু করলো;
– কলে জল উঠছে না এক ফোঁটা। হারুদের পাম্পে জল উঠছে না আজ শুক্রে শুক্রে আটদিন। মাটির তলার জল কি দাদা তবে নাই হয়ে গেলো?
– তোদের ওই ইরি বোরো চাষের ডিপটিউবওয়েল তো তলার সব খালি করে দিচ্ছে রে…!
– চাষ না করলেও তো চলে না দাদা!
– আর চাষ! তার জন্যে কত জল নষ্ট হচ্ছে বল্! দুনিয়া তো একটাই! তিনবার চাষ কর্ আর তেত্রিশ কোটি বার কর্। বেশি যা দেবে এই মাটি তা কি ফেরত নেবে না! সবই সেই সাড়ে তিন হাত কম্বলের মতো রে! মাথা ঢাকতে গেলে পা উদোম হবে! আবার পা ঢাকলে মাথা!
– ইরি বোরো চাষ কি আজ থেকে হচ্ছে ধনা দা?
চাষের মরশুম আসে বলেই তো মানুষ চাষ করে?
– আগে খরা মরসুমে ইরি বোরো এসবের চাষ ছিল নারে সদা! আউশ আর আমন হতো মেঘের জলের উপর! আর খরা মরশুমে রবিশস্য হতো। এখন কি রবিশস্য আছে?
– রবিশস্য আছেই তো টুকটাক।
– সে নামেই আছে রে সদা! টুক আর টাক মেলে তো আর ঢাকের আওয়াজ হয় না! ওই যে বলে কাজির গরু গোয়ালে আছে কিতাবে নেই! তেমনিই।
শোন্! প্রকৃতি নির্ভরতা কমিয়ে মানুষ যেদিন থেকে গায়ের জোড়ে এ পৃথিবীকে ব্যবহার করা শুরু করেছে সেদিন থেকেই তো প্রকৃতির রূপ বদলে যাচ্ছে রে….
– কিন্তু তা না করে কি উপায় আছে ধনা দা? মানুষ বাড়ছে। খাদ্য চাহিদা বাড়ছে। সে মোতাবেকই তো যোগান ঠিক করতে হবে। তাই নয় কি? বিঘা প্রতি দ্বিগুন ধানের ফসল উঠছে এখন। এক ফসলি, দু ফসলি সব জমি এখন তিন ফসলি। তারপরও দেখ না খাবারের কত নটখট, কত ঝকমারি, ভজকট! উপায় কি আছে আর? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সদা তাকিয়ে থাকে ধনার দিকে।
– উপায় তো কোনো কিছুরই নেই সদা। আমরা সব সময় বিকল্প খুঁজে বেড়াই। এইটে হলো না তো ওইটে। কিন্তু জীবনের কী বিকল্প হয় রে! যাপনের ভিন্নতা থাকতেই পারে কিন্তু খেয়ালি সুখের লোভে, যাপনের বিলাসিতায় আমরা জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছি যে!
তুই তোর জমি তিন ফসলি কেন? পারিস তো বারো মাসে তেরো ফসলি কর। কিন্তু তাতে যদি বারো হাত কুমড়োর তেরো হাত বিঁচি গজায় তাতে কি লাভ ভেবেছিস?
এই যে জল সেচের নামে জলের শ্রাদ্ধ করছি। মাটিতে বাহারি ক্যামিক্যাল সার দিচ্ছি, এ তো ঘুরে ফিরে আমাদের উপরেই ফিরে আসবে রে! চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলছে ধনঞ্জয়।
– তোমার কথাতো সত্য বলেই মনে হয়। কিন্তু কি বলবো আমরা। নিতান্ত পেট খোর মানুষ! তবে এই জলের কষ্টটা এবার হাড়মাস জ্বালিয়ে খাচ্ছে। কিন্ত ধনা দা গেল বছরেও তো এতো জলের আকাল ছিল না! এখন কেন তবে এমন জলের তকলিফ হচ্ছে?
– শোন রে সদা! মটির তলায় যে জল আছে সে জলের স্তর ধীরে ধীরে আরও নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রতিদিন চাষের নামে কিংবা শিল্প কারখানার নামে ডিপটিউবওয়েল খোঁড়া হচ্ছে। হিসাব ছাড়া জল তোলা হচ্ছে। তাতে ছোট খাট কলগুলোতে জল উঠছে না।
– ওহ্ কী সাংঘাতিক! তবে তো সামনের দিনগুলোতে আরও জলের কষ্ট হবে!
– হবেই তো! জল জল করে মরবে মানুষ! একদিন দেখিস! এই গাছ, এই ফসল, মানুষজন একদিন সব মরবে!
– বলো কী! বিভৎস চোখে সদানন্দ চেয়ে থাকে ধনঞ্জয়ের দিকে।
– অত উতলা হয়ে তুই আমি করবটা কী বলতো সদা! আমরা হলাম আমড়া-জনতা! আমাদের মাথাও নেই, চিন্তাও নেই! পুরো দেহটাই জুড়ে খালি একটা পেট। চল্ ওইটে নিয়ে খুশি থাকি। আমরা মাথায় চিন্তা করলে মাথা ওয়ালারা কী ছাই চিন্তা করবে বলতো? ওদের ভাবনা ওরা ভাবুক। তারচে বরং চল আমরা একটু বিড়ি টেনে নিই। নইলে যুত হচ্ছে না তো, কী বলিস!তারপর দুজনে দুটো বিড়ি ধরিয়ে পরপর টানতে লাগলো সদানন্দ আর ধনঞ্জয়। বিড়ির প্রত্যেকটি টান এখন সুখটান ওদের!
