“জগতে যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নী ও বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি, কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা”
“নারী” কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম এমন শব্দ চয়নে নারীর যতই বন্দনা করুক না কেন, সেই তিনিই আবার প্রিয়ার বিরহে কাতর হয়ে জেলে বসে যখন ‘পূজারিণী’ লেখেন, তখন প্রিয়া তাঁর অবর্তমানে অন্য কারো হয়ে যাবে ভেবে ঈর্ষাকাতর হয়ে উচ্চারণ করেছেন,
“নারী নাহি হতে চায় শুধু
একা কারো,
এরা দেবী,এরা লোভী,
যত পূজা পায় এরা,তত চায় আরো…
ইহাদের অতি লোভী মন,,
একজনে তৃপ্ত নয়,
এক পেয়ে সুখী নয়,
যাচে বহুজন।”
আসলে শুধু নজরুলকে দোষী করলে হবে না। এটাই হলো নারী সম্পর্কে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। নারী যতক্ষণ পুরুষের মর্জিমতো চলে, ততক্ষণ সেই নারী লক্ষীমন্ত,পয়মন্ত, আর নারী যখনই ‘লালসালু’ উপন্যাসের জমিলার মতো স্বাধীনচেতা,সাহসী,উচ্ছ্বল তখনই সেই নারীর ওপর নেমে আসে মজিদরূপী পুরুষদের খড়গ। কখনো কখনো ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসের হুরমতীর মতো নারীকে নিতে হয় চরিত্রহীনার অপবাদ। নারীকে এ সমাজ বাধ্যগত,পদানত রাখতে চায়। এর অন্যথা হলে ‘গেলো,গেলো’ রব। তাই তসলিমা নাসরিনের চেয়ে অনেক অশ্লীল সাহিত্য চর্চা করেও এ সমাজের পুরুষ সাহিত্যিকরা বাহ্বা কুড়ান, আর তসলিমা নাসরিন হন নিন্দিত। তসলিমার ‘লজ্জা’ উপন্যাসে সমাজের নিদারুণ সামাজিক-ধর্মীয় বৈষম্যই তিনি তুলে ধরেছিলেন যা পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য উপাত্তই। কিন্তু সেসব তথ্য-উপাত্ত প্রদানকারী সাংবাদিক কিংবা সম্পাদকদের দেশ ছাড়তে হয়নি। কিন্তু একজন নারীর উচ্চকণ্ঠ এ সমাজ মেনে নেয়নি। রাষ্ট্র তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি।
আমরা চারপাশে প্রতিনিয়ত নারীকে দমিয়ে রাখার নানাচিত্র প্রত্যক্ষ করি,কিন্তু এড়িয়ে যাই। মজার ব্যাপার হলো অনেক নারী এই অবদমনের প্রক্রিয়াটাকে ভালোবাসা বলে ভুল করে। আমার পরিচিতা এক নারী আছেন,তাঁর নিজের পছন্দে পোশাক কেনার কিংবা পরার স্বাধীনতা নেই। তাঁর স্বামীই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তকারী। এই কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাবকে সেই নারী স্বামীর অপার ভালোবাসা বলে পরিচিতমহলে গর্ব করে বলে বেড়ান। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের পোশাকের ব্যাপারে নিজের ভালোলাগার কথা জানাতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সমস্যাটা হয়ে যায় তখনই,যখন ব্যাপারটা একতরফা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। আমার পরিচিতা সেই নারীর অতি প্রিয় পোশাক শাড়ি হওয়া সত্ত্বেও স্বামীর অপছন্দের কারণে গত বিশ বছর তিনি শাড়ি পরতে পারেননি। এমনকি দুই/তিনটা রঙের বাইরে সালোয়ার-কামিজ পরার স্বাধীনতাও তাঁর নেই। এ নিয়ে তাঁর গোপন মনোবেদনা আমি জানি,কিন্তু মানুষের কাছে ছোট হয়ে যাবেন বলে তিনি ব্যাপারটাকে তাঁর প্রতি স্বামীর গভীর ভালোবাসা বলে প্রচার করেন।
প্রায় পনের বছর আগে এক দম্পতিকে চিনতাম, স্ত্রী বোরকা,হাত-মোজা,পা-মোজা পরতে রাজি না হওয়ায় তাঁদের দশ বছরের সুখের সংসার ভেঙে গিয়েছিল। অথচ তিনি জেনেশুনেই তেমন নারীকে বিয়ে করেছিলেন এবং দশবছর সুখে সংসারও করেছেন। পরে তাঁর চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে এবং তিনি তা তাঁর স্ত্রীর ওপরও চাপিয়ে দিতে চান। কিন্ত স্ত্রী তো আগের মতোই থাকতে চান। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব, শেষ পর্যন্ত ‘অবাধ্য স্ত্রী’কে তালাক। বিচ্ছেদ হওয়ার পর স্বামীটি বুঝেছিলেন তাঁর স্ত্রীকে ছাড়া বাঁচা অসম্ভব এবং সত্যি সত্যি পাঁচ বছরের মাথায় তিনি মারা যান। কিন্তু মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি প্রাক্তন স্ত্রীর সঙ্গে কোনো সমঝোতায় যাননি। শুধু পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদ সন্তানসহ চারটি মানুষের জীবন তছনছ করে দেয়৷
শুধু মুসলিম সমাজ নয়,হিন্দু সমাজেও নারী নির্যাতন,নারীর অবমূল্যায়ন ভয়াবহ। এ সমাজের বেশিরভাগ পুরুষের কাম্য সীতার মতো অনুগত স্ত্রী, যিনি স্বামীর জন্য নিজের সর্বসুখ বিসর্জন দেবেন। কিন্তু অসম্মানের প্রতিবাদে সীতা যে প্রতিবাদ দেখিয়ে গেছেন,তা বোঝার মতো ক্ষমতা বর্তমানের রামচন্দ্রদের নেই। সীতা প্রজাদের সামনে সতীত্বের পরীক্ষা দিয়ে রাজা রামের সম্মান রেখেছিলেন দুবার,তৃতীয়বারে রামকে ত্যাগ করে তিনি পৃথিবীর কোলে আশ্রয় নিয়েছেন৷ অর্থাৎ সীতাই দেখিয়ে গেছেন বাড়াবাড়ির শাস্তি কীভাবে দিতে হয়। কিন্তু আমাদের বেশিরভাগ রামচন্দ্র সীতার আনুগত্য পছন্দ করলেও প্রতিবাদের দিকটি মানতে নারাজ। সম্প্রতি পরিচিত এক দম্পতি বিচ্ছেদের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন শুধু নিরামিষ খাওয়াকে কেন্দ্র করে। ইসকন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে হিন্দু সমাজের অনেকেই এখন নিরামিষাশী হচ্ছেন। এ দম্পতির স্বামীপ্রবর নিরামিষাশী হলেও স্ত্রীকে কিছুতেই রাজি করাতে না পেরে ডিভোর্স দিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। পরে যদিও আত্মীয়স্বজনের হস্তপেক্ষে সমঝোতায় আসেন তাঁরা৷ ভাবা যায় কতটা পুরুষতান্ত্রিকতা! স্ত্রীর খাদ্যরুচিও স্বামী ঠিক করে দেবেন। অথচ নারীটি কিন্তু বলেননি স্বামীটিকেও আমিষ খেতে হবে। এ প্রসঙ্গে অনেকে হয়তো বলবেন,অনেক পরিবারে উল্টোটিও আছে। হ্যাঁ,হয়তো আছে,তবে তা একেবারেই নগন্য।
আমাদের সমাজ এমন এক সমাজ, সন্তান জন্ম দিতে না পারার অপরাধে সর্বগুণে গুণান্বিতা হওয়া সত্ত্বেও ডিভোর্স লেটার হাতে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসতে হয় একজন নারীকে। অথচ যাঁর কথা বলছি তিনি অশিক্ষিত, অথর্ব কোনো নারী নন। একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। যিনি ডিভোর্স লেটার ধরিয়ে দিলেন তিনিও একজন শিক্ষক। অর্থাৎ এইসব পুরুষ যে শিক্ষার অভাবে,অজ্ঞতার কারণে নারীকে অবমূল্যায়ন করছেন তা নয়,এঁরা মননে,চিন্তায়,রক্তের ধারাবাহিতায় পুরুষতান্ত্রিক। তাঁদের কাছে নারী মানে সন্তান জন্মদান এবং ঘরের সকল কার্য সমাপনের যন্ত্র। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,” ইহারাই নারীকে এক গ্রাসে গলাধঃকরণ করিতে চায়।” অথচ কখনো শোনা যায়নি মা হতে না পারার ব্যর্থতায় কোনো নারী তাঁর স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছেন।
বেগম রোকেয়ার সময়ের মতো এখন নারীকে অন্তঃপুরে আবদ্ধ করে রাখা হয় না। কিন্তু বাইরে পদচারণা করলেই নারীমুক্তি আসে না। অনেকে বলেন, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতাই নারীকে মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে কি তাই? ১৯৮০ সালে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি চালু হওয়ার পরেই লক্ষ লক্ষ নারী ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। আপাতদৃষ্টিতে তাঁরা স্বাবলম্বী নারী। তাছাড়া স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক, এনজিও,সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ সবক্ষেত্রেই নারীরা সদর্পে পদচারণা করছে। কিন্তু আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি এসব স্বাবলম্বী নারীরা তাঁদের পরিবারে,পরিমণ্ডলে তাঁদের যথাযোগ্য মূল্যায়ন পাচ্ছেন? খতিয়ে দেখলেই দেখা যাবে, পরিবার বলুন আর পরিমণ্ডল বলুন সবক্ষেত্রেই নারীর মেধা,শ্রম আর অর্থটা কেড়ে নিয়ে তাঁকে একটা মানবযন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে শুধু নারী হওয়ার অপরাধে তাঁর জন্য প্রযোজ্য পদ থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তাঁর চেয়ে কম মেধার পুরুষের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ এ সমাজ নারীকে ‘ডিসিশন মেকার’রূপে দেখতে চায় না৷ তাঁরা শুধু আজ্ঞাবহ হিসেবেই কাজ করবেন। এ প্রসঙ্গে হয়তো অনেকেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় স্পিকার কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন আরও কয়েকজনের কথা বলতে পারেন৷ কিন্তু আনুপাতিক হারে তাঁদের সংখ্যা নগন্যতর।
আমার এই আলোচনা পুরুষদের বিরুদ্ধে নয়,পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে। রাজা রামমোহন রায়,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিংবা বেগম রোকেয়ার যুগকে অতিক্রম করে আজ আমরা অনেকদূর এগিয়ে এসেছি। তা সম্ভব হয়েছে পুরুষরা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে। বর্তমানে বোর্ডের পরীক্ষার পরিসংখ্যানে আমরা দেখি ছাত্রদের থেকে সংখ্যায় এবং মেধায় ছাত্রীরা এগিয়ে। কিন্তু শিক্ষিত হলেই নারীরা অত্যাচারিত হবে না,অবমূল্যায়িত হবে না এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমন যদি হতো তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুরকে চোখ হারাতে হতো না স্বামী হাসান সাঈদ সুমনের হাতে। সুমন নিজেই বুয়েটের স্নাতক ডিগ্রিধারী ছিলেন। দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী একজন নারী বীভৎস সহিংসতার শিকার হয়েছেন আরেকজন সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীর হাতে। এর কারণ সুমনের পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদ,যা তিনি সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও অতিক্রম করতে পারেননি। রুমানা ঘর ছেড়ে বিদেশে গিয়ে একা থাকবেন,তাঁকে ছাপিয়ে উচ্চতর ডিগ্রির ক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে যাবেন সেটা সুমনের আধিপত্যবাদী মন মেনে নিতে পারেনি।
আসলে নারীর আত্মরক্ষার ভার নিজেদেরকেই নিতে হবে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মাসিপিসি’ গল্পে আমরা দেখেছি লম্পট জমিদার গোকুলের চৌকিদারবাহিনীকে ঠেকাতে মাসি ও পিসি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে,পরে নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনা করে চিৎকার দিয়ে জনতার সম্মিলন ঘটিয়েছে। বেগম রোকেয়াও তাঁর নারীজাগরণমূলক প্রবন্ধসমূহে নারীদের ‘শারীরিক শক্তি’ এবং ‘মানসিক শক্তি’ অর্জনের কথা বলেছেন। আমাদেরকে সেই পথই অনুসরণ করতে হবে। গোলাপের মতো তুলতুলে সুন্দর আর কমনীয় হয়ে থাকার মানসিকতা থেকে নারীদের বেরিয়ে আসতে হবে। আত্মমর্যাদা রক্ষা করতে হলে নারীকে প্রথমে মানসিক শৃঙ্খল ভেঙে আত্মবলে বলীয়ান হতে হবে। ‘কে কী বলবে’ এই চিন্তাধারা ঝেরে ফেলতে হবে। সবার আগে নিজের সম্মানের জায়গাটা নিশ্চিত করতে হবে। আমি যদি নিজেকেই সম্মান করতে না পারি,তাহলে অন্যের কাছ থেকে কী করে সম্মান আশা করবো? কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,”আত্মাকে জাগাতে পারলেই আত্মশক্তি আসে।” সর্বস্তরের নারীকে নিজের আত্মাকেই জাগাতে হবে। আত্মা জাগলে আত্মশক্তি আপনাআপনিই আসবে। একজন আত্মশক্তিসম্পন্ন নারীই পারে নিজেকে মর্যাদার সাথে বাঁচাতে। আপামর পুরুষদের প্রতি বিদ্বেষ নয়,পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদ লালনকারী সেইসব কূপমণ্ডূকদের(নারী-পুরুষ যেই হোক) চিন্তাধারাকে মাড়িয়ে এ সমাজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় উচ্চারণ করুক—
“উড়াব ঊর্ধ্বে প্রেমের নিশান দুর্গমপথমাঝে
দুর্দম বেগে দুঃসহতম কাজে
রুক্ষ দিনের দুঃখ পাই তো পাব
চাই না শান্তি, সান্ত্বনা নাহি চাব
পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি আছি।”
পরিবারে,সমাজে,রাষ্ট্রে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াসটাই জরুরী। শিশুকাল থেকেই পরিবারে, শিক্ষালয়ে,সামাজিক পরিমণ্ডলে শিক্ষা দিতে হবে নারী পুরুষ পরস্পরের প্রতিপক্ষ নয়,পরিপূরক।