ড. মনওয়ার সাগর
ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এমন একটি স্থানে অবস্থিত, যেখান থেকে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ অঞ্চলের দেশসমূহে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ফলে বঙ্গোপসাগরের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছে। ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ (ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে যে দেশগুলি রয়েছে) অঞ্চলে প্রায় তিনশ কোটি মানুষের বাজার। অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ চায় আমেরিকা, চীন, ভারতের মতো শক্তিগুলি।
ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে যেসব দেশ রয়েছে সেগুলোকে একত্রে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল বলা হয়। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে; রয়েছে জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও বাংলাদেশের মতো ডজনখানেক দেশ। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর পাশাপাশি রয়েছে অনেক উঠতি অর্থনৈতিক পরাশক্তির দেশ। ফলে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ও উঠতি উদীয়মান শক্তিধর দেশের মেলবন্ধনে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল বিশ্বব্যাপী আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে বর্তমানে। তাছাড়া অর্থনীতি তথা আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য এবং প্রযুক্তিগত কর্মকাণ্ডসহ ব্যাপক সমরাস্ত্রসজ্জিত মহড়ার দরুন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল পরিণত হয়েছে বৈশ্বিক ভূরাজনীতির বড় বিজ্ঞাপনে।
বাংলাদেশেকে ঘিরে ভারত- আমেরিকা -চীনের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের অর্ন্তনিহিত কারণ এই ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। সেন্টমার্টিন ও বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে ইন্দোফেসিপিক জোন এর মোড়লদের ভূ রাজনৈতিক স্বার্থ দীর্ঘদিনের।
দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নে ভারত ও চীন পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত। সময়ে সময়ে তাদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। আবার দীর্ঘদিন থেকে ভারত ও আমেরিকা নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক রক্ষা করে আসছে। এ সত্ত্বেও ভারত এবং চীন উভয়েই এক মেরু বিশ্ব থেকে বহু মেরু বিশ্বের দিকে যেতে চায়, এ জন্যই দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্যের প্রশ্নে ভারত আমেরিকার মুখোমুখিও দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশের ৭ জানুয়ারি নির্বাচনকে ঘিরে আমেরিকা, চীন ও ভারতের ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব, আমেরিকা-ভারত বিরোধের মধ্যে দিয়েই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এটি অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশে চীন বা আমেরিকার চেয়েও ভারতীয় হস্তক্ষেপের মাত্রা তীব্র ও প্রকট। বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি ভারতের কাছে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে সাথে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সংহতির দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের তিন দিকই ভারতীয় সীমান্ত দ্বারা বেষ্টিত। ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান অনেকটা ভারতের বুকের ভেতর। ভারত মনে করে বাংলাদেশে অন্য কোন শক্তির অবস্থান তাদের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। আবার ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ খাত ৭টি রাজ্যের সাথে সংযোগ ও সংহতি ধরে রাখতে হলেও এ নিয়ন্ত্রণ তাদের চাই। ‘চিকেন নেক করিডোর’ দিয়ে‘সেভেন-
সিস্টার্সে’ যাতায়াত, নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড ব্যবহার করতে পারলে তাদের সময় ও খরচ দুটোই বাঁচে। সাত বোন খ্যাত রাজ্যগুলিতেও কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। তাই যেকোন মূল্যে বাংলাদেশের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম ভারতের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলকে ঘিরে ইতিমধ্যেই একটি জটিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণ গড়ে উঠেছে। সেই সমীকরণের চিপায় পড়ে আওয়ামীলীগ আমেরিকার বাইডেন প্রশাসনের বিরাগভাজন হয়েছিল।
গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ চীনের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ চীনের। বাংলাদেশে যে ১০০টি ‘ইকোনোমিক জোন’ ও ২৭টি ‘হাইটেক পার্ক’ নির্মাণ হচ্ছে সেখানে চীনের গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ ও অংশগ্রহণ আছে। আবার চীন বাংলাদেশের সামরিক সরঞ্জামের প্রধানতম যোগানদাতা। এ স্বত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্ধারক ভূমিকা নিচ্ছে ভারত। এ কথা সত্য যে, ভূ-রাজনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই ভারত তার নিরাপত্তার স্বার্থে সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অথচ বাংলাদেশের জন্য স্পর্শকাতর অঞ্চলগুলিতে নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যেই ট্রানজিটের নামে ভারত করিডোর সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। পণ্য পরিবহণের নামে পাওয়া করিডোর সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলিতে রাজনৈতিক সংকট ও বিদ্রোহ দমনের জন্য ভারতীয় সেনা বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহার করতে পারে- এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদী অন্তর্দ্বন্দ্ব যত তীব্র হবে, ভারত-চীন দ্বন্দ্বও তত প্রকট হবে। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ভারতের জন্য ভূ-সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। আবার একইভাবে চীনও তার অর্থনৈতিক প্রভাব খাটাবে। ফলে বাংলাদেশের মানুষ যুক্ত হয়ে পড়বে একটি অযাচিত সংকটে।
তাই – আমেরিকা,চীন,ভারতের সাথে যে কোনো চুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনেক সচেতন ভাবে এগোতে হবে।ভূ-রাজনীতি এবং ভূ অর্থনীতির বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর।এই সমীকরণটা অনেক জটিলও বটে।যা সাধারণ মানুষের বোঝার কথা নয়।
এ ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদ এবং রাজনীতিবিজ্ঞানের শিক্ষকদের দায়িত্ব হচ্ছে জনসচেতনতামূলক আর্টিকেল লিখে জনগনকে সচেতন করা।যাতে বাংলা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে জনগণ একই সুরে কথা বলতে পারে।দেশপ্রেমের চেতনায় জাগ্রত হতে পারে।
বাংলাদেশের সাথে আমেরিকা, চীন ও ভারতের সম্পর্ক যতোটা না বন্ধুত্বের তার চেয়েও বেশী স্বার্থের। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে সরকারই আসুক – এই শক্তিধর দেশগুলোর সাথে কৌশলগত সম্পর্ক রাখতেই হবে,না রেখেও উপায় নেই।শুধু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ দেখার পাশাপাশি আমাদের সচেতন থাকতে হবে যে,যাতে করে আমাদের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন না হয়।