এস এম শহীদ উদ্দিন সমীর:
আমরা যারা জিপিএ চালু হওয়ার আগের জমানার মানুষ, আমাদের শিক্ষাজীবনে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা ছিল এসএসসি। স্বাভাবিকভাবেই এই পরীক্ষা নিয়ে আমাদের ভয় আর উৎকন্ঠা যেমন ছিল চরম মাত্রার, তেমনি আশানুরূপ রেজাল্ট করার উদগ্র বাসনাও ছিল সীমাহীন।
১৯৯২ সাল। এসএসসি পরীক্ষা তখন আমাদের জীবনের একটি বড় অধ্যায়। সেই সময়ের প্রস্তুতি যেন এক বিশেষ ধাপ, যেখানে পড়াশোনা, দোয়া প্রার্থনা এবং জীবনের সাধারণ বিনোদন এক নতুন ছকে বাঁধা পড়ত। আমার কন্যার বয়সী আজকে যারা পরীক্ষা দিচ্ছে, তাদের আবেগ কিংবা উৎকন্ঠা হয়ত আমাদের মত সেই পর্যায়ে যাবে না, তবুও এই পরীক্ষা তাদের একাডেমিক অর্জনের খাতায় প্রথম নতুন পালক যোগ করবে।
মনে পড়ে, আশপাশের বাড়ী আর স্কুলের পরীক্ষার্থী সিনিয়র ভাইবোনদের হঠাৎ সমীহ জাগানো চেহারার উদয় হতো স্কুলগুলোতে। আমরা জানতাম, তারা পরীক্ষার্থী, কেমন যেন একটা শ্রদ্ধা আর সম্মান সম্মান ভাব চলে আসতো। ৯০ দশকে সাধারণত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে পরীক্ষা হতো।
ফেব্রুয়ারি থেকে আমের বোলে পাগল করা ঘ্রাণ তখন বাতাসে। সর্বত্র যেন প্রশান্তির দিনগুলো বেশ উজ্জ্বল ঝকঝকে। আমাদের টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট হয়ে যেত নভেম্বরের শেষ বা ডিসেম্বরের শুরুতেই। তারপর আর স্কুলে যাওয়া নেই। ১০ বছর স্কুল জীবনশেষে প্রি-টেস্ট ও টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ আমরা পরীক্ষার্থীরা এসএসসি ক্যান্ডিডেট নামেই পরিচিত থাকতাম বাসায়, স্কুলে, পাড়ায়। আড়াই-তিন মাসের জন্য ঢুকে যেতাম বাড়ীতে। পাড়ার মাঠে যারা ফুটবল খেলত দিনমান, ফনিক্স সাইকেল নিয়ে ঘোরাঘুরি করত যারা স্কুল কামাই করে, কিংবা যারা দুই বিনুনি বেঁধে রোজ স্কুল যেত সকাল-বিকেল, তারা সবাই তখন ‘ক্যান্ডিডেট’।
যারা সারা বছর পড়েনি, তারা পড়তে শুরু করত, রুটিন মেনে, টেস্টপেপার সলভ করে। আর যারা সারা বছর পড়েছে, তারা স্টার পাওয়ার জন্য, কেউ কেউ বোের্ড স্ট্যান্ড করার আশায় দিন-রাত উজাড় করে দিত এই তিন মাস। আমাদের ক্লাসের মারুফ এখন বড় ইঞ্জিনিয়ার, সবচেয়ে বেশি পড়ুয়া শিপন সরকার কলেজের শিক্ষক ।
আমার বাবা মা সারাক্ষণ ওকে নিয়ে আমাকে কম্পারিজন করত, বলতো তুমি তো কিছুই পড়ো না, দেখে এলাম শিপন, মারুফ স্কুল থেকে গিয়েই পড়া শুরু করেছে!
ক্লাসের সবাই ছিল একেক জন অলরাউন্ডার। ক্লাসে এই সব জিনিয়াস ব্রিলিয়ান্টদের ভিড়ে আমি সব সময় টক্কর খেতাম।
এসএসসি পরীক্ষার সময় আমার মা নামাজ শেষে প্রতিনিয়ত আমার শরীরে দোয়া কালাম পরে ফু দিত! আম্মা গতকালও আমাকে ফোন করে আমার মেয়ের জন্য ও সেই আমল বলে দিল, স্পেশাল কিছু খাবারের কথাও মনে করিয়ে দেয়। মা-বাবারা আসলে এরকমই! আগে বুঝতে পারতাম না! আমার মেয়ের এই প্রথম পাবলিক পরীক্ষা দেয়ার উত্তেজনা অনেক বেশি ফিল করতেছিলাম। আমাদের এসএসসি পরীক্ষাকে ঘিরে জীবনের লক্ষ্য ছিল একটাই—ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়া। আমাদের সময়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়ার জন্য প্রযুক্তির বাড়াবাড়ি কোনো বাঁধা ছিল না। বিনোদনের সীমাবদ্ধতাই হয়তো আমাদের পড়ালেখায় আরও মনোযোগী করেছিল।
আর এখনকার প্রজন্ম! যুগ পাল্টেছে, বদলেছে শিক্ষা ব্যবস্থাও। এখনকার বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা স্মার্টফোনে ডুবে থাকে। পরীক্ষার আগের রাতেও ফেসবুক বা অন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় স্টোরি দেওয়া কিংবা মজার পোস্ট করায় ব্যস্ত থাকে। পড়াশোনা যেন আর প্রথম অগ্রাধিকার নয়। অভিভাবকরাও এখন সন্তানদের শিক্ষার পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করলেও প্রযুক্তির প্রতি তাদের এই আসক্তি আটকাতে হিমশিম খান।
স্পষ্ট মনে পড়ে আমার এসএসসির দিনগুলোয় আমাদের মা-বাবা সামর্থ অনুযায়ী স্পেশাল খাবারের সাথে একটু দুধ, কলা, বিকেলে ডিম, হরলিকস যোগ করতেন। বিশ্রাম আর যত্নে, নিয়ম করে পড়ার মধ্য দিয়ে আমাদের চেহারা আড়াই-তিন মাসে খানিকটা বদলে যেত। দেখলেই কেমন যেন সবাই সমীহ জাগাত। পাড়ার অনুষ্ঠান বা যেকোনো উৎসব-মাহফিলে খেয়াল করা হতো আশপাশের বাড়িঘরে কেউ ক্যান্ডিডেট আছে কি না। থাকলে মাইকের শব্দ একটু কমিয়ে দিত। সবাই জানত, কোন বাড়িতে কারা পরীক্ষা দিচ্ছে, কে কেমন রেজাল্ট করবে, সে বিষয়েও থাকত একধরনের প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা মা-বাবা-পরিবার ছাড়িয়ে পাড়া-মহল্লা-স্কুলেও থাকত।
মনে হতো বাড়ির ভাই বোন আব্বা-আম্মা সকলের মুরুব্বিয়ানা আদেশ-উপদেশের মাঝে আমার এসএসসির দিনগুলো কি বিবর্ণ!
পরীক্ষার দু-এক দিন আগে আশপাশের বাড়ির মুরব্বিরা এসে খোঁজ নিতেন, আমি যেদিন আমাদের বাড়ি থেকে এসএসসি পরীক্ষার জন্য উপজেল যাই আমাদের পাড়ার প্রত্যেক বাড়িতে আমি গিয়েছি দোয়া নিতে। ১৯৯২ সালের ৭ ই এপ্রিল আমাদের পরীক্ষা শুরু হয়। স্পষ্ট মনে পড়ে পরীক্ষার দিনে তেল-জবজবে মাথায় পানি ঢেলে, পবিত্র চেহারায় পরীক্ষা দিতে যাই ।
সবাই জানতেন এসএসসি পরীক্ষার দিন সেদিন। পরীক্ষা শেষে আমাদের কেউ পরীক্ষার হল থেকে আগেই বের হলে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন অন্য পরীক্ষার্থীদের অপেক্ষমাণ অভিভাবকেরা।
আমার পরীক্ষা শেষ হলে আমি দেখতাম বাবা পরীক্ষা হলে গেইটে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতো আর হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করতো কেমন হলো। নিশ্চিত হতে চাইতেন পরীক্ষায় প্রশ্ন কমন পড়েছে তো! পরীক্ষা শেষে হল থেকে বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত কতজন যে জিজ্ঞস করতেন পরীক্ষা কেমন হলো, প্রশ্ন সব কমন পড়ল কি না, বিশেষ করে বাংলা-ইংরেজি পরীক্ষায় রচনা কমন পড়ল কি না, অঙ্ক পরীক্ষার দিনে লেটার উঠবে কি না—এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমরা ঘরে ফিরতাম। তখনকার দিনে এসএসসি পরীক্ষা ছিল সত্যিকারেরভাবে পরীক্ষার্থীদের ঘিরে এক উৎসব। সেই উৎসবের ঘ্রাণ ছড়ানো থাকত অজপাড়া গা থেকে শহর জুড়ে সর্বত্রই। এই এসএসসি পরীক্ষার মধ্য দিয়েই আমরা কিশোর-কিশোরীরা যেন বড় হয়ে উঠতাম।
১৯৯২ সালের স্মৃতি আজও জীবন্ত। সে সময়ের প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত, টানা পড়ার টেবিলের লড়াই, আর বিদ্যুতবিহীন হারিকেন কুপি বাতির আলোতে পড়ার অভিজ্ঞতা যেন এখনো হৃদয়ে গেঁথে আছে। আর বর্তমান প্রজন্মকে দেখে এই শিক্ষা নেওয়া যায়—পরিবর্তন জরুরি, তবে সেটা ইতিবাচক হতে হবে।
মেয়ের এসএসসি :
এখন আর সেই প্রেক্ষাপট নেই যে আমার মত মা নামাজ শেষে প্রতিনিয়ত শরীরে দোয়া কালাম পরে ফু দেওয়া। নেই পরীক্ষা সকালে স্পেশাল খাবারের সাথে একটু দুধ, কলা, বিকেলে ডিম, হরলিকস দুপুরে মজাদার খাবার।
নেই বাবার মত পরীক্ষা হলে গেইটে আপেক্ষা প্রথম প্রশ্ন পরীক্ষা কেমন হয়েছে। সকল প্রশ্ন কমন পড়েছে কত কথা।
সময় ও বাস্তবতা এখন এক জন এক জাগায়। অপেক্ষা করতে হয় ফোন জন্য।
মেয়ে পড়ে ফেনী ক্যাডেট কলেজ। বড় জন ঝিনাইদা ক্যাডেট কলেজ । মেয়ের মা চাকুরী কারনে রামু। ছোট জন আর আমি ঢাকা।
মেয়ের জীবনেও তৈরি হয় নাই সব স্মৃতি, তার স্মৃতি অন্যরকম যা একদিন ফিরে দেখতে গর্ব বোধ করবে।
অবারিত শুভকামনা তোমাদের সব নতুন পরীক্ষার্থীদের জন্য।