আমি গুণীজন ও মেধাবী ব্যক্তিদের সন্মান করি, দেশপ্রেমিককে শ্রদ্ধা করি, তা সে যে দলেরই হোক, যে সংস্থারই হোক।কিছু মানুষ আছেন যারা মেধা, উচ্চতা ও আদর্শে সময়কে অতিক্রম করে যান।
তাঁদের প্রজ্ঞা, উচ্চতা, আর সময়কে ছাপিয়ে যাওয়া ব্যক্তিত্বের ছায়ায় দেশ, জাতি, মানবতা আলোকিত হয়! অনেকের আবার মেধা ও উচ্চতা থাকলেও আদর্শ ও নৈতিকতার অনুপস্থিতিতে তাদের সকল অর্জন ম্লান হয়ে যায়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড.আশিক চৌধুরীর ইনভেস্টমেন্ট সামিটের প্রেজেন্টেশনসহ বেশকিছু প্রেজেন্টেশন দেখলাম ও শুনলাম। অনেকটা মুগ্ধ হয়ে শুনলাম তাঁর কি প্লানিং, কি আইডিয়া। তাঁর প্রতিটি প্রেজেন্টেশন শুনে আমি যুগপৎভাবে মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছি।
এক কথায় –
This presentation is not just a presentation! It’s the view & a message from the country to the World!
এখন দেখার বিষয় হচ্ছে- তিনি আসলে বাংলাদেশকে কোন পথে এগিয়ে নিতে চান? ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশ এমন একটি অবস্থানে আছে যে, পথ ভুল করলেই আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমিত্ব বিপন্ন হবে।
জিও পলিটিক্স, জিও ইকোনোমিক্স এর বিষয়টিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে।আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ব্যাবসার উদ্দেশ্যে এসে আমাদের ২০০ বছর পআমাদের শাসন করেছিল। আমরা এই বিষয়টা নিয়েও বেশ কনসার্ন আছি। আমি বিশ্বাস করি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি আমরা যেমন কমিটেড তেমনি দেশের স্বার্থে আমরা সকলে সচেতনও আছি।
আমি মনে করি বিনিয়োগ ছাড়া দেশের উন্নয়ন হবেনা সেটা যেমন সত্য, আবার যাকে তাকে বিনিয়োগ করতে দেয়া যাবেনা সেটাও সত্য।বিনিয়োগ না থাকলে শিল্প-ব্যবসা- বাণিজ্য বিকাশের গতি শ্লথ হবে, তারল্য সংকট দেখা দেবে,ব্যাংকে অলস টাকা পড়ে থাকবে- এটাই স্বাভাবিক।
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়, বিনিয়োগের আগে দেশে ব্যবসায় পরিবেশ তথা বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরী করা প্রয়োজন।বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান পাঁচটি বাঁধা হলো বিদ্যুতের সমস্যা, অর্থায়নের সীমিত সুযোগ, দুর্নীতি, অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিক্য ও উচ্চ করহার। এছাড়াও দেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রেগুলেটরি বা নিয়ন্ত্রণমূলক সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, নীতির ঘন ঘন পরিবর্তন, সুশাসনের অভাব, আইনের জটিলতা, প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতা, সমন্বয়ের অভাব ইত্যাদি।
বৈদেশিক বিনিয়োগ এর সুবিধার পাশাপাশি বিনিয়োগের সমস্যাও রয়েছে। সেগুলো হলো:
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘ সূত্রিতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অবকাঠামোগত জটিলতা ও সমস্যা মুখোমুখি হওয়া, অদক্ষ শ্রমিক, বাজারের সংকীর্ণতা, শ্রমিক অসন্তোষ, দুর্নীতি ও আইন- শৃঙ্খলার অপব্যবহার।ডিজিটাল আর্থিক সেবায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মার্চেন্টদের লেনদেন সীমা বাড়ানোর মতো কিছু জটিলতাও আছে।
বিগত সরকারগুলোর আমলেও বাংলাদেশে বিদেশিদের আকর্ষণে নানামুখী নীতি প্রণয়ন হলেও এর ধারাবাহিকতা ছিলনা বা নেই। বিনিয়োগের উপযোগী হিসেবে আস্থা অর্জন থেকেও বারবার ছিটকে পড়তে হয়েছে দেশকে। এ ছাড়া পরিবহন ও সরবরাহ খাত, গ্যাস-বিদ্যুতের মতো বিভিন্ন পরিষেবা ক্ষেত্রেও কিছু সমস্যা রয়েছে। এ সকল সমস্যার কারনে সারা বিশ্বে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পৌনে ২ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশের কমেছে পৌনে ১৪ শতাংশ।আইএফসির প্রতিবেদনে অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বিদেশি বিনিয়োগ খুবই অপ্রতুল।
আইএফসির প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের কৌশলগত চারটি খাতে প্রয়োজনীয় নীতিগত পদক্ষেপ নিলে প্রতিবছর এসব খাতে প্রায় ৩৫ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। খাত চারটি হলো আবাসন, পেইন্ট অ্যান্ড ডাইস, তৈরি পোশাকশিল্প ও ডিজিটাল আর্থিক সেবা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশের আবাসন খাতে ডিজিটাল ম্যাপিং, জমি নিবন্ধন ও জমির অতিরিক্ত দাম নিয়ে জটিলতা রয়েছে। ভূমি ও বঙ্গপোসাগরের প্রশ্ন আসলে আমি কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়ি। কেননা আমাদের সেন্টমার্টিন, বঙ্গোপসাগর নিয়ে দীর্ঘদিনের একটা ষড়যন্ত্র ও ত্রিমুখী চাপ রয়েছে।বিনিয়োগটা বঙ্গপোসাগরীয় অঞ্চল ভিত্তিক হওয়ার প্রশ্ন আসলে আমার শংকাটা আরও তীব্র হয়। বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল মানে ইন্দোফেসিপিক জোন।এই জোনকে ঘিরে ৩০০ কোটি মানুষের বাজার অর্থনীতি জড়িয়ে আছে। সেজন্য এই অঞ্চলের গুরুত্ব যেমন রয়েছে তেমনি এই অঞ্চলকে ঘিরে আমেরকা, চীন, ভারতের জটিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণ গড়ে উঠেছে। দেশী বিদেশী এমন অনেক ষড়যন্ত্র থাকতে পারে যা আমাদের বুঝার বা জানার মত সক্ষমতা নেই।আমরা যা কিছুই করিনা কেন আমাদের সমুদ্র অঞ্চলকে সংরক্ষিত রেখেই করতে হবে। আমি মনে করি তাড়াহুরা না করে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আলোকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে করণীয় নির্ধারণ করলে ভালো হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো – বিনিয়োগ এর পরিবেশ তৈরী করা,দেশের ভৌগলিক অঞ্চল নিরাপদ করা, সমুদ্র অঞ্চল সংরক্ষিত রাখা, বিনিয়োগ কারী প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বিধান করা। আমরা দেখেছি অতি সম্প্রতি বিডা যখন বিদেশী বিনিয়োগ কারীদের আহব্বান করছে তখন বিদেশী সংস্থাগুলো (বাটা,কোকাকোলা) ভাংচুর হচ্ছে,সরকার নিরাপত্তা দিতে পারেনি,তাহলে বিনিয়োগকারী আসবে কেন?বিনিয়োগের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ভবিষ্যতে লাভবান হওয়া এবং অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করা।তারা সেই নিশ্চয়তা না পেলে আসবে কেন?
তবে আমি আশাবাদী মানুষ।আমি আশাকরি জনাব আশিক চৌধুরী -বাংলাদেশে বেশকিছু উদ্যোক্তা তৈরী করতে পারবেন।বিদেশী বিনিয়োগ লগ্নি করতে পারবেন। সরকার কাজ হচ্ছে বিনিয়োগ এর পরিবেশ তৈরী করা,বিনিয়োগ কারী প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বিধান করা।এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন,দেশের ভৌগলিক অঞ্চল নিরাপদ করা,সমুদ্র অঞ্চল সংরক্ষিত রাখা।যাতে আমাদের সেন্টমার্টিন ও বঙ্গপোসাগর নিরাপদে থাকে।কোনো সার্বভৌম দেশের ভূখণ্ড অন্য কোনো দেশ ক্ষমতায় রাখার বিনিময়ে বিনিয়োগ করতে চাইলে সে ক্ষেত্রে ভেবে চিন্তেই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।ভূ রাজনীতির কৌশল অবলম্বন করা উচিত।
সবশেষে যে কথাটি না বললেই নয়, জনাব আশিক চৌধুরীর একটি কথা আমার ভালো লেগেছে। তিনি বলেছিলেন, “গণতন্ত্র মানেই ভিন্নমত, মানেই প্রশ্ন তোলা। তাই আমরা ভুল করব, আবার শিখব, আবার শুধরাবো। ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে—দেশটা এগোবে। আমরাও এগোবো।এই এক মাসে বুঝেছি—দেশে কাজ করা মানে শুধু চেয়ারে বসে থাকা নয়, না ঘুমিয়ে, না খেয়ে একের পর এক মিটিং করা। নতুন আইডিয়া খুঁজে বের করা, নীতিমালায় পরিবর্তন আনা, আমলাতান্ত্রিক জট ছাড়িয়ে উদ্যোক্তাদের জন্য পথ সুগম করা। সবার চোখে এটা “চাকরি” হলেও, আমার কাছে এটা একধরনের “মিশন”।” তবে সেই মিশন যেনো দেশের স্বার্থে হয়।