ধর্মীয় অনুভূতিগুলো খুবই স্পর্শকাতর।অন্যের বিশ্বাস ও ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে কটাক্ষ করা কখনো মত প্রকাশের স্বাধীনতা হতে পারেনা।
কেউ ধর্মকে কটাক্ষ করে ভাইরাল হতে চায়,নিজের পরিচিতি বাড়াতে চায়, আবার কেউ ধর্মকে পূঁজি করে বৈতরণী পার হতে চায়।
আমরা প্রাচীন গ্রিস, রোমান সাম্রাজ্য, প্রাচীন চীন ও ভারতের ইতিহাস পরিভ্রমণ করে আসলে দেখতে পাবো, রাজা- রাজন্যরা ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে তুলে নিয়েছিল ধর্মকে। শুধু বাংলাদেশই নয়, পৃথিবীজুড়ে ভোটের মুদ্রা হয়ে ওঠে ধর্ম। আমরা ভোটের আগে উপমহাদেশের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকে দেখেছি পীরের বাড়ি যেতে।
রাজনীতির এই ব্যবহারই রাষ্ট্র পর্যায় থেকে একদম পরিবার পর্যন্ত ধর্মকে স্পর্শকাতরের কাতারে পৌঁছে দেয়। অসাম্প্রদায়িক সহজ মানুষ হয়ে ওঠে অসহিষ্ণু মানুষ। আমাদের গ্রামগুলো যে তাদের অসাম্প্রদায়িক গুণ হারিয়েছে, তার জন্য কোনও ধর্ম দায়ী নয়। দায়ী তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া ধর্ম নির্ভর ভোটের রাজনীতি। এ কথা সত্য যে, ধর্ম বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্যই সবচেয়ে বেশি কাজে লাগানো হয়।
রাজনীতিবিদেরা ধর্মকে পূজি করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে আর লেখকেরা ধর্মকে পূঁজি করে নিজের পরিচিতি বাড়াতে।
মানুষের প্রাত্যহিকতার অংশ ধর্ম। ব্যক্তিগতভাবে মানুষ ধর্ম অনুশীলন করে।আমিও ধর্মকে অনুশীলন করি।বিশ্বাস করি।
কোনও মানুষ ধর্মে বিশ্বাস করে না, এটাও আমার কাছে অবিশ্বাস্য। সৃষ্টিকে যে বিশ্বাস করে, তার পক্ষে ধর্মচ্যুত হওয়া সম্ভব নয়। আমার মতে সকল ধর্মই সুন্দর। সকল ধর্মেই ভালো কথা বলা আছে,ব্যক্তির অসহায়ত্ব, নিঃসঙ্গতা, নির্বাণে সঙ্গ দেয় ধর্ম।
এটা এমন একটা স্পর্শকাতর বিষয় যে, একবার গণ অসন্তোষ দেখা দিলে – সরকারও সেটা নিয়ন্ত্রুণ করতে পারেনা। সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো মুহুর্তেই দানবীয় রূপ নেয়। আমাদের সমাজের অগ্রসর অংশের অনেকেই অবশ্য রাজনৈতিক কারণে এ ধরনের গণ–উন্মাদনায় উৎসাহ দিয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ধর্মকে ব্যবহার করে গণ–উন্মাদনা তৈরির সংস্কৃতির দায় তাঁরা কি এড়াতে পারবেন?
সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং অগ্রসর জনগোষ্ঠির একাংশের কারণে যারাই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে তাদেরকেই নির্বাসনে যেতে হয়।যেমনটা বাংলাদেশের দুজন মন্ত্রী ও দু’জন কবিকে নির্বাসিত হতে হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার, দ্বিতীয় কবি – তসলিমা নাসরীন। আমি ঠিক জানিনা – কবি দাউদ হায়দার আস্তিক,নাস্তিক নাকি অজ্ঞেয়বাদী। সে বিচারের জন্য সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন।
আমি তাঁকে একজন কবি হিসাবেই জানি।
গতকাল শনিবার স্থানীয় সময় রাত নয়টায় জার্মানির বার্লিনে শ্যোনেবের্গ ক্লিনিকে তিনি মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি বার্লিনের রাইনিকেডর্ফ এলাকায় একটি ভবনের ১২ তলায় একটি ফ্লাটে একাকী বসবাস করতেন।
কবিতা লেখার অপরাধে চার দশক তাকে আটকে রাখা হয়েছে স্মৃতির কারাগারে। যে দেশে অজস্র যুদ্ধ অপরাধী দম্ভের পতাকা উড়িয়ে দাবড়ে বেড়াচ্ছে ছাপ্পান্ন হাজার, সেখানে কবিতা লেখার অপরাধে একজন কবি প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরতে পারেন না- বড়জোর প্লেনের জানালা দিয়ে একনজর দেখতে পারেন ফালি ফালি শষ্যক্ষেত, মনের মধ্যে আঁকুপাঁকু করে হয়তো ‘ওইখানে পাবনা- ওইখানে ইছামতী’!
দেশের যদি হাত থাকতো, দুহাত বাড়িয়ে তাকে বুকে টেনে নিতো। কিন্তু দেশ তো শাসনের ম্যান্ডেট, ক্ষমতার আস্ফালন, কট্টর প্রতিক্রিয়াশীলতার দোর্দন্ড প্রতাপ, দেশতো ব্লাসফেমী- কবিতা লেখার অপরাধে মাথা কেটে নেবার ফতোয়া।
বাংলাদেশের এই একজন কবিই আছেন যিনি কবিতা লেখার অপরাধে নির্বাসিত।জার্মানীতে কী নেই- সব আছে।কিন্তু কোথায় দাউদ হায়দারের ইছামতী নদী!একটি কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন অগ্রসর ভাবনার কবি দাউদ হায়দার।
দাউদ হায়দার দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতার সম্পাদক ছিলেন সত্তর দশকের শুরুর দিকে। ১৯৭৩ সালে লন্ডন সোসাইটি ফর পোয়েট্রি দাউদ হায়দারের কোন এক কবিতাকে “দ্যা বেস্ট পোয়েম অব এশিয়া” সম্মানে ভুষিত করেছিল। সংবাদের সাহিত্যপাতায় ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎসায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন ।ধারণা করা হয়ে থাকে, তিনি ঐ কবিতাতে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ), যিশুখ্রীষ্ট এবং গৌতম বুদ্ধকে অপমান করেছিলেন । তাঁর সংগস অব ডেস্পায়ার বইতে এই কবিতাটি সংকলিত আছে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে প্রচন্ড প্রতিবাদ শুরু করে এবং ঢাকার কোন এক কলেজের শিক্ষক ঢাকার একটি আদালতে এই ঘটনায় দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন
’৭৪-এর ২২ মে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ নির্দেশে কলকাতাগামী একটি ফ্লাইটে তাকে তুলে দেয়া হয়। ওই ফ্লাইটে তিনি ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিল না। কবির নিরাপত্তায় উদ্বিগ্ন ছিল মুজিব সরকার। ’৭৬-এ দাউদ হায়দার তার পাসপোর্ট নবায়নের জন্য কলকাতাস্থ বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে জমা দিলে তা আটক করা হয়।
ভারতে গিয়েও রক্ষা পাননি কবি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর নির্দেশে তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়। হাইকমিশনার তাঁর বাসায় গিয়ে, বাসা মানে দাউদ হায়দার ভারতে যাঁর আশ্রয়ে থাকতেন সেই বাড়ীতে গিয়ে পাসপোর্ট নিয়ে আসে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলে তিনি আটক পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে আবেদন করেন। তার পাসপোর্ট ফেরতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এরশাদ সরকারও। পাসপোর্ট ছাড়া অন্য আরেকটি দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসে সমস্যা দেখা দেয়। ভারত সরকার দায়িত্ব নিতে চায় না নির্বাসিত কবির। তিনি অন্য কোনো দেশেও যেতে পারেন না পাসপোর্টের অভাবে।
এদিকে ভারত সরকার তাঁকে ভারত ত্যাগের ফাইনাল নোটিশ দেয়- “… য়্যু হ্যাভ নো কেইস ফর গ্রান্ট অব লংটার্ম ষ্টে ফ্যাসিলিটিজ ইন ইন্ডিয়া এন্ড য়্যু আর দেয়ারফর রিকোয়েষ্টেড টু লীভ ইন্ডিয়া ইম্মিডিয়েটলি উইদাউট ফেইল।” ১৯৮৫ সালে পেন আমেরিকান সেন্টারের ২০০০ লেখকের পক্ষ থেকে ভারতের প্রধান মন্ত্রীর কাছে একটা চিঠি লেখা হয় যাতে দাউদ হায়দারকে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়ার অনুরোধ করা হয়। এর পিছনে কবির বন্ধু অন্নদাশঙ্কর রায়ের প্রভাব ছিল।
এর পর নোবেল লরিয়েট জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস ভারত সফরে এসে পুরো ঘটনা শুনলেন। কথা দিয়ে গেলেন তাঁকে “তোমার জন্য কিছু একটা করবো।
তিনি জার্মান সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত কবিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
জাতিসংঘের বিশেষ ‘ট্রাভেল ডকুমেন্টস’ নিয়ে ঘুরেছেন দেশান্তরে। কোনো পাসপোর্ট নেই তার। জার্মানি যাওয়ার পর থেকে তিনি সেখানের ‘ডয়েচে ভেলে’ রেডিও চ্যানেলের প্রভাবশালী সাংবাদিক।
দাউদ হায়দারের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’, ‘সম্পন্ন মানুষ নই’, ‘নারকীয় ভূবনের কবিতা’, ‘যে দেশে সবাই অন্ধ’, ‘ধূসর গোধূলি ধূলিময়’, ‘আমি ভালো আছি, তুমি?’
তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে আরও রয়েছে-‘নির্বাসিত’, ‘সংগস অব ডেস্পায়ার’, ‘এই শাওনে এই পরবাসে’, ‘বানিশম্যান্ট’, ‘আমি পুড়েছি জ্বালা ও আগুনে’, ‘এলোন ইন ডার্কনেস অ্যান্ড আদার পোয়েমস’, ‘হোল্ডিং অ্যান আফটারনুন অ্যান্ড আ লিথ্যাল ফায়ার আর্ম’, ‘অবসিডিয়ান’।
১৯৭৪ এর ২৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় তার কবিতা ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ প্রকাশিত হলে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের’ অভিযোগে তার বিরূদ্ধে মামলা হয়। এবং তাঁকে নির্বাসিত হতে হয়।
দাউদ হায়দারের ভাইদের মধ্যে প্রয়াত হয়েছেন নাট্যকার জিয়া হায়দার, কথাশিল্পী রশীদ হায়দার ও কবি মাকিদ হায়দার। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন জাহিদ হায়দার, আবিদ হায়দার ও আরিফ হায়দার। তারা সবাই সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত।
আমি জানি না তার এই জীবন নিয়ে আক্ষেপ ছিল কি না।তবে কবি দেশান্তরী হওয়ার গভীর বেদনার কথা লিখেছেন ‘তোমার কথা’ কবিতায়। ১৯৮৩ সালে কলকাতায় অবস্থানকালে দাউদ হায়দারের কলমে উঠে আসে-
.. মাঝে মাঝে মনে হয়
অসীম শূন্যের ভেতর উড়ে যাই।
মেঘের মতন ভেসে ভেসে, একবার
বাংলাদেশে ঘুরে আসি।
মনে হয়, মনুমেন্টের চূড়ায় উঠে
চিৎকার ক’রে
আকাশ ফাটিয়ে বলি;
দেখো, সীমান্তে ওইপাশে আমার ঘর
এইখানে আমি একা, ভীনদেশী।
দ্রোহের কবি দাউদ হায়দারের প্রয়াণে শোক ও বিনম্র শ্রদ্ধা। আপনি চলে গেলেও আপনার সৃজনী শক্তি আর ভালো ভালো সৃষ্টির জন্য বেঁচে থাকবেন পাঠকের মাঝে। আপনার ভুলগুলো সৃষ্টিকর্তা ক্ষমা করুন।
ওপারে ভালো থাকুন কবি।